ফোন পেলেই চা নিয়ে হাজির রনি
মোটরসাইকেলের নেমপ্লেটের ওপরে লেখা, ‘ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকান’
নিউজডোর ডেস্ক ♦ মোটরসাইকেলের দুই পাশে বড় বড় দুটি করে চারটি ফ্লাক্স। পেছনে সিটের আসনে বড় ঝুড়িতে রাখা আছে ওয়ানটাইম কাপ, পানিসহ অন্যান্য জিনিস। মোটরসাইকেলের নেমপ্লেটের ঠিক ওপরে একটি বোর্ডে সাদা কাগজে লেখা, ‘ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকান। এখানে মসলাযুক্ত চা এবং দুধ চা পাওয়া যায়।’ ওই বোর্ডের নিচের দিকে নাম ও দুটি মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া আছে। সকাল ৯টা থেকেই চায়ের ভোক্তাদের ফোন আসতে থাকে ওই দুই নম্বরে। আর মোটরসাইকেলে তিনি চলে যান চা–সেবা দিতে।
রাজশাহীর পবা উপজেলার দহপাড়া গ্রামের তেঁতুলতলা এলাকার মো. রনি (৩৫) করোনাকালে বেছে নিয়েছেন এমন ব্যবসা। মোটরসাইকেলে করে তিনি গ্রামে-শহরে ঘুরে চা বিক্রি করেন।
রনির কষ্টে ভরা জীবনঃ
সাত বছর বয়সে রনির মা মারা যান। দুই সন্তানকে রেখে বাবা বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। রনি ও তাঁর বোনের ঠাঁই হয় নানির সংসারে। নানা মারা গিয়েছিলেন আগেই। সংসার চালাতে শিশু বয়সে রনি তুলে নেন বাদামের ঝুড়ি। এরপর কিছুটা বড় হয়ে রনি ভ্যান চালাতে শুরু করেন। বিয়ের পর স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে আর্থিক অনটনে পড়েন। ছয় বছর আগে বাড়ির পাশে তেঁতুলতলা বাজারে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান দেন তিনি। যা পেতেন, তা দিয়ে সংসার চলে যেত। করোনাকালে গত বছর রাজশাহীতে লকডাউন শুরু হলে আবার আর্থিক সংকটে পড়েন তিনি।
করোনাকালের কঠিন সময়ঃ
গত বছরের এপ্রিলে রাজশাহীতে লকডাউন শুরু হলে এক বিকেলে পুলিশ তাঁর চায়ের দোকান খুলতে মানা করে। এরপর দুই ফ্লাক্সে করে চা নিয়ে হেঁটে হেঁটে বিক্রি শুরু করেন। তবে হেঁটে খুব বেশি পরিমাণ চা বিক্রি করতে পারতেন না। পুরোনো সাইকেল কিনে মেরামত করে ফ্লাক্স নিয়ে বের হন। সাইকেলে ঝুলিয়ে দেন ফোন নম্বরসহ একটি বোর্ড। এতে ভালো সাড়া পড়ে। চায়ের সুনামও মুখে মুখে ছড়ায়। গত ডিসেম্বরে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এবং নিজের কিছু টাকা দিয়ে পুরোনো মোটরসাইকেল কেনেন। লোহার তৈরি দুই পাশে দুটি বাক্স তৈরি করে সেখানে চা-ভর্তি চারটি বড় ফ্লাক্স রাখার ব্যবস্থা করেন। মোটরসাইকেলের পেছনে সিটের ওপরে একটি ঝুড়ির মতো বানিয়ে সেখানে রাখেন ওয়ানটাইম কাপ, পানিসহ অন্যান্য জিনিস।
রনি চাচার চায়ে জাদু আছে। তাঁর চা দোকানের মতো না। (রনির চায়ের ক্রেতা মো. শুভ)।
এভাবে চা বিক্রি শুরু করলে আশপাশের লোকজন রনিকে দেখে টিপ্পনি কাটতেন। কিছুটা বিচলিত হলেও হাল ছাড়েননি তিনি। এখন প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০ কাপ মসলা ও দুধ চা বিক্রি করেন রনি। প্রতিদিন তেল খরচ ও অন্যান্য খরচ বাদে থাকে হাজার টাকার মতো। এই টাকায় চলছে তাঁর সংসার, ঋণের টাকাও দিচ্ছেন।
এটা খুব ভালো লাগার যে মোটরসাইকেলে করে এই দেশের কোনো একটি গ্রামে চা বিক্রি হচ্ছে।
(রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী শ্যামল)।
রনি চাচার চায়ে জাদু আছেঃ
রনিকে চা বানানোর কাজে সহযোগিতা করেন তাঁর স্ত্রী রানু বেগম। সকালে তাঁর স্ত্রী বড় পাতিলে পানি গরমে দেন। এরপর রনি এসে মসলাপাতি, চা-চিনি ও দুধ দেন। এরই মধ্যে ফোনে বিভিন্ন জায়গায় চা পৌঁছে দেওয়ার অর্ডার পেতে থাকেন। এরপর মোটরসাইকেল নিয়ে গন্তব্যের দিকে ছোটা শুরু হয় তাঁর। তাঁর দুই ছেলে তামিম ইসলাম (১৩) ও জিম ইসলাম (৯) মাদ্রাসায় পড়ে। রনি মসলাযুক্ত চা ৫ টাকা আর দুধ চা ১০ টাকায় বিক্রি করেন।
রনির চায়ের একজন ক্রেতা মো. শুভ বললেন, ‘রনি চাচার চায়ে জাদু আছে। তাঁর চা দোকানের মতো না।’ রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী শ্যামল বলেন, এটা খুব ভালো লাগার যে মোটরসাইকেলে করে এই দেশের কোনো একটি গ্রামে চা বিক্রি হচ্ছে।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আক্কাস আলী বলেন, চা বিক্রি করে রনি সংসার চালাচ্ছেন, দুই ছেলেকে পড়াচ্ছেন। রনি ফোন পেলে আর দেরি করেন না। দ্রুত চা পৌঁছে দেন।
রনির প্রত্যাশা, করোনাকাল দ্রুত শেষ হবে। এই ভ্রাম্যমাণ চা ব্যবসাকে তিনি আরও ছড়িয়ে দিতে চান। নিজের ব্যবসাকে বড় করতে টাকা জমিয়ে আরও মোটরসাইকেল কিনে কিছু মানুষকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে চান। তিনি চান, তাঁর এই উদ্যোগ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ুক।
তথ্য ও ছবি প্রথম আলো অনলাইন থেকে হুবহু কপি করা।