শিক্ষিত হওয়ার বাসনার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন উজ্জ্বল
মেরিনা লাভলী ♦ জুবায়ের হোসেন উজ্জ্বল। ২০ বছরের যুবক। তার বহুমাত্রিক শারীরিক প্রতিবন্ধীতা ছোট্ট বেলা থেকেই। হাত-পা দিয়ে আর দশটা মানুষের মত কাজ করতে পারেন না তিনি। উজ্জ্বলের কঠিন ইচ্ছাশক্তির কাছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, শিক্ষিত হওয়ার বাসনার বাধা হতে পারেনি। বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়ছেন মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে। নিজ বিছনাকে বানিয়েছেন শ্রেণি কক্ষ। দিন-রাত মুখ দিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে বই পড়েন। পাঠ্য পুস্তকের বিভিন্ন অধ্যায়ের প্রশ্নগুলির উত্তর লেখেন মুখ দিয়েই।
শুধু তাই নয়, মুখ দিয়ে পরিচালনা করা মোবাইল দিয়ে ইউটিউবসহ বিভিন্ন অনলাইন থেকে ক্লাস করেন। সেই ক্লাস অনুযায়ী বই পড়েন। উজ্জ্বলের প্রবল ইচ্ছা শক্তি যেন, সকল প্রতিকূলতাকে হার মানিয়েছে। মুখ দিয়েই ল্যাপটপ চালু করা, কী-বোর্ডের বোতাম চাপা, কার্সার নাড়ানোসহ ল্যাপটপে নানা দাপ্তরিক কাজ প্রতিনিয়ত রপ্ত করছেন। তার স্বপ্ন, পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে সম্মানজনক পেশায় নিজে নিযুক্ত হওয়া। এমনই এক প্রতিরোধ্য প্রতিবন্ধী যুবকের গল্পটি রংপুর মিঠাপুকুর উপজেলার বালারহাট ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম হযরতপুরের।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, হযরতপুরের ক্ষুদ্র কৃষক জাহিদ সারোয়ারের তিন সন্তানের মধ্যে উজ্জ্বল দ্বিতীয়। বড় ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে একটি বেসরকারী এনজিওতে চাকুরী করার সুবাদে থাকেন সিলেটে। বিয়ের পর আর পরিবারের দায়িত্ব নেননি তিনি। ছোটবেলাতেই ধরা পড়ে তৃতীয় সন্তান উজ্জ্বলের শারীরিক প্রতিবন্ধীতা। বাড়ন্ত উজ্জ্বল যখন বসতে পারে না, তখন বাবা জাহিদের মুখে চিন্তার ছাপ পড়ে যায়। দীর্ঘ ১০ বছর শিশু বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে চিকিৎসা নেয়া, পল্লী চিকিৎসক, কবিরাজকে দেখানো, থেরাপী দেয়াসহ উজ্জ্বলের নানা চিকিৎসা চালায় তার বাবা। এসব করে মুখের লালা পড়া বন্ধ হওয়া ছাড়া আর তেমন কোন শারীরিক উন্নতি হয়নি উজ্জ্বলের। শেষমেশ বুকের ধন উজ্জ্বলকে আগলে রেখেই এখন দিন যায় জাহিদ সারোয়ারের। বই পড়া ছাড়া কোন কাজ নিজে করতে পারে না উজ্জ্বল। তাই বইকেই জীবন সঙ্গী করে সময় কাটান উজ্জ্বল।
ছোট্ট বেলায় যখন উজ্জ্বলের ছোট বোনকে পড়াতেন তার বাবা পাশে শুয়ে থাকা উজ্জ্বল তখন থেকে কথা শুনে শুনে পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন বিষয় রপ্ত করে ফেলতেন। এ বিষয়টি বাবা জাহিদ বুঝতে পেরে উজ্জ্বলকে স্কুলে ভর্তি করান। এরপর বাড়িতে থেকে বাবা ছাড়া অন্য কারো সাহায্য ছাড়াই উজ্জ্বল লেখাপড়া করে চলছেন। জেএসসি পাশ করে শেরপুর দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে জিপি ৪ দশমিক ৩৩ পয়েন্ট অর্জন করেন উজ্জ্বল। এরপর ভর্তি হন বালারহাট আদর্শ ডিগ্রী মহাবিদ্যালয়ে। সেখানে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন তিনি। নিজ বিছানায় লেখাপড়া করে বোর্ড পরীক্ষায় আলাদা কক্ষে বিছানায় শুয়ে অতিকষ্টে মুখ দিয়ে লেখেন তিনি। এটি দেখে আশ্চর্য হয়ে যান পরীক্ষক, শিক্ষকসহ উজ্জ্বলের সহপাঠীরা। পরীক্ষকরাও নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষাগুলোতে আধাঘন্টা সময় বেশি দেন উজ্জ্বলকে। করোনাক্রান্তিতে এইচএসসি পরীক্ষা না হওয়ার শংঙ্কায় মন খারাপ উজ্জ্বলের। মুখ দিয়ে লিখে বোর্ড পরীক্ষায় সম্মানের সাথে পাস করতে চান তিনি। লেখাপড়ার পেছনে এমন আগ্রহের কারণে উজ্জ্বল এখন একটি প্রেরণার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে রংপুরে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বালারহাট হযরতপুরের পাকা সড়ক থেকে নেমে কাঁচা রাস্তা দিয়ে যেতে হয় উজ্জ্বলের বাড়িতে। রাস্তার দু’ধারে সরষে ক্ষেত শীতের বাতাসে দুলছে। এক কিলোমিটারের মত পথ পাড়ি দিয়ে উজ্জ্বলের বাড়ির দেখা মেলে। সাড়ে ৮ শতক জমির উপর টিনের চার চালা ঘর উজ্জ্বলদের। উঠান ঘিরে থাকা ৪টি ঘরের মধ্যে একটিতে থাকেন উজ্জ্বল ও তার বাবা-মা। করোনাকালীন এইচএসসি ফল প্রকাশের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে উজ্জ্বলের ছোট বোনের। উজ্জ্বলের ঘরে ঢুকতেই দেখা যায় ল্যাপটপে করে এক্সেলে বেতন শীট তৈরী করছে উজ্জ্বল। ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া মোবাইল ফোনে উজ্জ্বল বেতন শীট তৈরীর নিয়ম দেখে ল্যাপটপে তা তৈরী করছেন। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এমন জীবন-সংগ্রাম চোখে দেখা, বড়ই আশ্বর্যের। বিছানার বালিশ সরিয়ে মুখ দিয়ে বই টেনে এনে পড়েন উজ্জ্বল, এরপর মুখ দিয়েই কলম ধরে মোটামুটি লাইন সোজা রেখেই লেখেন তিনি। পড়তে পড়তে ঘেমে যান উজ্জ্বল। পাশে বসে থাকা বাবা জাহিদ বারবার উঠে উঠে মাথা-মুখ মোছানোর কাজ করেন।
বিজ্ঞানের মত কঠিন বিষয়টি বেছে নেয়ার কারণ হিসেবে উজ্জ্বলের পরিবার জানালেন, বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলোতে লিখতে হয় কম। যেহেতু উজ্জ্বল মুখ দিয়ে লেখে তাই কম সময়ে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া সহজ একমাত্র বিজ্ঞান বিভাগেই। উজ্জ্বল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ কোরআন পড়েন। অদম্য উজ্জ্বলের খোঁজ পেয়ে তার বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন রংপুরের জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ল্যাপটপ কিনতে সহায়তা করেছে জেলা প্রশাসন। এছাড়া সম্প্রতি রংপুর টাউন হলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এমপি’র উপস্থিতিতে ঘটা করে উজ্জ্বলকে আর্থিক সহায়তা ও সম্মাননা প্রদান করেছে প্রশাসন।
উজ্জ্বলের বাড়িতে তার সাথে কথা হলে অস্পস্টভাবে তিনি বলেন, আমার লেখাপড়া করতে ভালো লাগে। আমি বড় হয়ে সরকারী চাকুরী করতে চাই। সরকারী চাকুরী।
উজ্জ্বলের বাবা জাহিদ সারোয়ার বলেন, প্রবল ইচ্ছাশক্তি তার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। উজ্জ্বল নিজেকে প্রতিষ্ঠিত হিসেবে দেখতে চায়। ৪ বিঘা জমিতে আমি চাষাবাদ করতাম। কিন্তু উজ্জ্বল বড় হওয়ার সাথে আর সেটি করতে পারিনা। তার ওজন বেড়েছে। আমি ছাড়া কেউ তাকে পায়খানা-প্রসাব করাতে নিয়ে যেতে পারে না। সারাক্ষন তার পাশে পাশে থাকতে হয়। এমনও হয়েছে আমি বাজারে গিয়েছি, উজ্জ্বল আমাকে ফোন করে। আমি বুঝতে পাই তার পায়খানা লেগেছে। সব কাজ ফেলে আমি সাইকেলে করে দ্রুত চলে আসি। উজ্জ্বলের জন্য আমি এখন চাষাবাদ করতে পারছিনা। আর আমি একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় সংসার অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে চলছে। এরপরেও আমি উজ্জ্বলকে কখনো বোঝা মনে করি নাই। তাকে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দিয়েছি। কিন্তু উজ্জ্বলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি চিন্তায় থাকি। আমি মারা গেলে কে তাকে দেখবে।
রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, উজ্জ্বলের খবর পেয়ে আমরা তার বাড়িতে যাওয়াসহ তার লেখাপড়ার জন্য ল্যাপটপ কিনতে সহযোগিতা করেছি। এছাড়া তাকে প্রতিবন্ধী ভাতার আওতায় আনা, আর্থিক সহায়তা দেয়া এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে সম্মাননাও দিয়েছি। উজ্জ্বলের পাশে প্রশাসন পূর্বেও ছিল ও আগামীতেও থাকবে। আমরা সার্বক্ষনিক তার খোঁজ-খবর নিচ্ছি।